উদয়পুরের গোমতী নদীর তীরবর্তী রাজ্যের পুরনো রাজবাড়ি এবং ঐতিহ্য মন্ডিত রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ভুবনেশ্বরী মন্দির আজ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত। পর্যটকদের এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ী ও ভুবনেশ্বরী মন্দির কে নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ। তবে এই ঐতিহ্য মন্ডিত পর্যটন কেন্দ্রটিকে আরও অধিক মনোগ্রাহী করে তোলার বিষয়টা কিন্তু চলে এসেছে। যেহেতু আর্কিওলজি দপ্তর এই ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানের একাংশের তদারকির দায়িত্বে রয়েছে, তাই তাদের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত।
উদয়পুরের গোমতী নদীর তীরবর্তী পুরনো রাজবাড়ী ও ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের প্রাচীন। কথিত আছে ১৬৬০ থেকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তৎকালীন মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য ভুবনেশ্বরী মন্দির স্থাপন করেছিলেন। উদয়পুর যখন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ছিল, তখন গোমতী নদী তীরবর্তী এই পুরনো রাজবাড়ী থেকেই রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন মানিক্য বংশের রাজারা। পরবর্তীতে মহারাজ কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য আগরতলায় রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। বর্তমান উদয়পুরের পুরনো রাজবাড়ীর প্রবেশে মুখেই মন্দির সদৃশ্য ছোট একটি দুর্গ রয়েছে। স্থানীয়দের মতে এই দুর্গে রাজার প্রহরীরা সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিতেন। আজ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত এই পুরোনো রাজবাড়ি এবং ভুবনেশ্বরী মন্দির।
স্থানীয় এবং দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে কথা বললে, তারা জানান দীর্ঘ প্রাচীন এই ঐতিহাসিক নিদর্শন কে সংরক্ষণ করার জন্য সরকারকে আরো বেশি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার এবং এই জায়গাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
আগরতলা রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরও রাজপরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের রাজমাতা এবং যুবরাজ এই ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানে পদার্পণ করেছিলেন বলে জানালেন জনৈক স্থানীয় বাসিন্দা।
তবে যতটুকু জানা গেছে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের মূল অংশটি আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এর দ্বারা সংরক্ষিত রয়েছে এবং দেখভালের জন্য লোক নিযুক্ত রয়েছে, ফলে এই অংশটির সৌন্দর্য বজায় রয়েছে। স্থানীয় সাধারনের মতে এখানে দিন দুপুরে বা সন্ধ্যের পর সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ সংগঠিত হয়। এসব দূর করে, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলে পুরনো রাজবাড়ী ও ভুবনেশ্বরী মন্দির যে পর্যটকদের অধিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।
তবে ২০০৭ সালে গোমতী নদীর উপর যোগেশ চক্রবর্তী সেতু নির্মিত হলে উদয়পুরের সঙ্গে পুরনো রাজবাড়ী ও ভুবনেশ্বরী মন্দিরের দূরত্ব ও যোগাযোগের অসুবিধা অনেকটাই ঘুচে যায়। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো রাজবাড়ী দেখার জন্য লোকজন আসেন, শিক্ষার্থীরাও শিক্ষামূলক ভ্রমণে এখানে আসে। কিন্তু অপরিচ্ছন্নতা এবং ভগ্নদশায় জর্জরিত ভুবনেশ্বরী মন্দির ও রাজবাড়ী রাজ্যের ঐতিহ্যতে ঠেস পৌঁছাচ্ছে বলে সাধারণের অভিমত।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী উপন্যাস রাজর্ষি ও বিসর্জন নাটক ভুবনেশ্বরী মন্দিরকে প্রতিপাদ্য করে রচিত হয়েছে। কথিত আছে এখানে একটা সময় পশুবলি এমনকি নরবলি হত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজর্ষি উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন একসময় মন্দির থেকে বলির রক্ত বয়ে গিয়ে গোমতীর জলধারায় মিশে যেত। রাজর্ষি উপন্যাসের উল্লেখিত চরিত্র হাসি ও তাতা দুই ভাই বোন।
একদিন কেদারেশ্বরের সঙ্গে গোমতীর ঘাটে স্নান করতে গিয়ে ছোট্ট মেয়ে হাসি মন্দির থেকে প্রবাহিত রক্তের ধারা হাত দিয়ে মুছে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছিলো, এত রক্ত কেন? তবু দীর্ঘ বছর ধরে এখানে বলি প্রথা চালু ছিল। রক্তের ধারা গোমতীর জল স্পর্শ করছিল, কিন্তু কখনো এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যকে। সেদিন ছোট্ট মেয়ে হাসির এই প্রশ্ন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কানে প্রতিধ্বনির মতো বারবার বেজে উঠেছিল। সেই একই প্রশ্ন এত রক্ত কেন? এরই মধ্যে হাসি ও তাতার সঙ্গে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জানা যায়, এই ঘটনার কিছুদিন পরেই প্রচন্ড জ্বরে হাসির মৃত্যু হয়। মহারাজ স্নেহের সান্নিধ্যে তাতাকে তিনি কেদারেশ্বরের কাছ থেকে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তার নাম দেন ধ্রুব। ইতিমধ্যে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য মাতা ভুবনেশ্বরীর সম্মুখে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বলি নিষিদ্ধ করার পক্ষে রাজদরবারে প্রস্তাব এবং নির্দেশ দেন। যদিও বলি প্রথা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে রাজ আমলাদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কে। এই সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজর্ষি উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন। কি রোমহর্ষক ঐতিহ্যপূর্ণ উদয়পুরের এই পুরনো রাজবাড়ি এবং ভুবনেশ্বরী মন্দির। তাতেই এই পর্যটন কেন্দ্র ইদানিং পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে এই পুরনো রাজবাড়ির একাংশ এবং ভুবনেশ্বরী মন্দিরের কিছু কিছু স্থান কিন্তু অপরিচ্ছন্নতা ও অবহেলায় বর্তমানে জনবর্জিত স্থানে পরিণত।